বাংলা ভাষাকে শিশুদের কাছে জনপ্রিয় করতে গুফির উদ্যোগ

সমাজের উঁচু শ্রেণীর পরিবারের শিশুরা, বিশেষ করে যারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে যায়, তাদের সন্তানদের অনেকেই বাংলা ঠিকমতো পড়তে পারে না। ইংরেজিতে তারা গড়গড় করে কথা বলতে পারে, ইংরেজি ভাষায় লেখা মোটা মোটা গল্পের বই এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলে। কিন্তু বাংলার প্রতি অনীহা। এটা নিয়ে অনেক অভিভাবকই আমাদের কাছে অভিযোগ করেছেন, এটা নিয়ে তাদের মনেও কষ্ট আছে। কিন্তু তারা কি করবেন সেটা তারা বুঝতে পারছেন না।

এটা একটা অদ্ভুত সমস্যা। বাংলা, নিজের মাতৃভাষা, সেটাতে কেন শিশুরা বই পড়ছে না? কিংবা এই ভাষাটাই তারা কেন পুরোপুরিভাবে শিখছে না?

এই সমস্যা নিয়ে যখন আমরা গভীরভাবে ভাবতে শুরু করলাম তখন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলাম সমস্যার মূল কোথায়। সমস্যার মূল হচ্ছে, একটা শিশু যখন ভাষা শেখা শুরু করে, তখন তার কাছে আমরা কি অপশন তুলে দিচ্ছি। এখন প্রতিটি শিশুর কনটেন্ট দেখা শুরু হয় ইউটিউবে। সেখানেই তারা শিখে ইংরেজিতে এ, বি, সি। বিভিন্ন শব্দ আর বাক্যও তারা শিখে ইংরেজিতে। কারণ কি?

কারণ হচ্ছে, বাংলাতে ভালো কনটেন্ট ইন্টারনেটে নেই। খালি ইংরেজি অক্ষর শেখাতে যে পরিমাণ কনটেন্ট আছে, বাংলা সব চ্যানেল মিলিয়েও শিশুদের উপযোগী কনটেন্ট নেই।

ইন্টারনেটের পরে আসে বই। যেহেতু সমাজের উঁচু শ্রেণীর অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের হাতে ভালোমানের বই তুলে দিতে চায়, সেখানে গিয়ে তারা ইংরেজিতে লেখা বইগুলোর মতো মানসম্পন্ন বই খুঁজে পায় না। ঢাকা শহরের ভালো ভালো বইয়ের দোকানে, কিংবা বিভিন্ন শপে – যেখানে সাধারণত উচ্চবিত্তরা যায়, সেখানে মানসম্মত ভালো বাংলা বই পাওয়া যায় না।

কেন পাওয়া যায় না? কারণ কনটেন্ট কোয়ালিটি ও বইয়ের প্রোডাকশন কোয়ালিটি – এই দুই বিবেচনাতেই আমাদের দেশের প্রকাশকরা এমন বই তৈরি করেন না। যে মানের বই তৈরি হয়, সেগুলো ওই ধরণের জায়গায় স্থান দেয়ার মতো না। তাতে করে সেই শপগুলো যাদেরকে টার্গেট করে, তাদের কাছে ইজ্জত থাকবে না।

দেশের প্রকাশকরা সাহস পায় না এতো ভালো মানের বই তৈরি করতে। কারণ তাদের ধারনা, এতো দাম দিয়ে কেউ বই কিনবে না।

এই পরিস্থিতিতে গুফি প্রথম উদ্যোগ নেয় ভালো মানের শিশুতোষ বাংলা বই তৈরিতে। এবং মূল লক্ষ্য থাকে, কন্টেন্ট, গল্প, ইলাস্ট্রেশন এবং প্রোডাকশন – এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই যেন আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা হয়। সবচেয়ে বেশি বলা ভাষার মধ্যে বাংলা পৃথিবীতে ৭ম স্থানে আছে। বাংলাদেশ ছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গ, এবং বিদেশে ১ কোটি বাঙালি আছে। তাই ভালো মানের বই তৈরি করতে পারলে বাজারজাতের সমস্যা নেই, ক্রেতারও অভাব হবে না। কিন্তু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ ও রিস্ক নেয়ার মানসিকতা।

ওয়ালিউল্লাহ ভুঁইয়া, লাইট অফ হোপের প্রতিষ্ঠাতা, তাই প্রথমেই পাবলিকেশন লাইসেন্স নিয়ে নিজেই প্রকাশক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। এরপর গঠন করেন একটা টিম যেখানে শিশু বিশেষজ্ঞ, ভাষা বিশেষজ্ঞ, গল্প লেখক, ডিজাইনার, ইলাস্ট্রেটর, ক্যারেক্টার আর্টিস্টসহ নানা ধরণের এক্সপার্টরা আছেন। সেই টিমের সাথে পরামর্শ করে তৈরি হয় বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক মানের শিশুতোষ বই তৈরির রূপরেখা।

ভাষাকে আনন্দ নিয়ে এঙ্গেজিং উপায়ে শেখানোর জন্য ২-৬ বছর বয়সী শিশুদের জন্য চিন্তা করা হয় নানা ধরণের কনটেন্ট ও লার্নিং প্রোডাক্ট। তৈরি হয় শত শত কবিতা, হাজার হাজার ক্রিয়েটিভ একটিভিটি। সেগুলোর উপর ভিত্তি করে তৈরি হয় বাংলা ফ্ল্যাশকার্ড সেট, ২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য। প্রি-স্কুল লেভেলের জন্য তৈরি হয় ‘বর্ণ নিয়ে খেলি’ সিরিজ। এখানে বাংলা ৫০টি অক্ষর নিয়ে বিভিন্ন ক্রিয়েটিভ একটিভিটি, কবিতার মাধ্যমে ভাষার প্রাথমিক ভিত্তি দেয়ার কাজ করা হয়। ‘বর্ণ যখন ছবি হল’ বইটির মাধ্যমে বাংলা ৫০টি বর্ণ থেকে ৫০টি ছবি আঁকা শেখানোর মাধ্যমে বাংলা ভাষার অক্ষরগুলো আরও আনন্দ নিয়ে শেখার উপায় তৈরি করা হয়। এই বইয়ের সিরিজটি এখন বিশ্বের ৯০টি দেশে ব্যবহার হচ্ছে।

২০২১ সালে ওয়ালিউল্লাহ ভুঁইয়া বাংলা ভাষায় গল্প তৈরির কাজকে নিয়ে যান এক অন্য উচ্চতায়। এটা পুরো পৃথিবীতে শিশুতোষ পাবলিকেশনের ইতিহাসে কেউ আগে কখনও করেনি। তিনি শুরু করেন ‘বর্ণগল্প’ নামে একটা সিরিজের কাজ। ৯ খন্ডের এই সিরিজে বাংলা প্রতিটি অক্ষরকে ঘিরে একটা করে গল্পের বই তৈরি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বর্ণগল্প ৬ পর্যন্ত প্রকাশ হয়েছে। ৯টি সিরিজের প্রতিটি সিরিজের একটা মূল থিম আছে। যেমন, নৈতিকতা, আত্মবিশ্বাস, সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, ভালো আচরণ ইত্যাদি।

যেমন, অ অক্ষরকে ঘিরে তৈরি হয়েছে ‘অলিজার গল্প’। এই গল্পটির মূল মেসেজ হচ্ছে অন্যর প্রতি দয়ালু হওয়া। কিন্তু পুরো গল্পের পাতায় পাতায় অ অক্ষর দিয়ে বিভিন্ন শব্দকে নিয়ে আসা হয়েছে। এতে করে শিশুদের শব্দভান্ডার বাড়বে। কঠিন শব্দগুলোর অর্থ দেয়া আছে বইয়ের শেষে।

এখানেই শেষ হয়। প্রতিটি বইয়ের শুরুতেই একটা কিউআর কোড সংযুক্ত করা আছে। সেখানে স্ক্যান করলেই পুরো গল্পটি শিশুদের পড়ে শুনানোর ভিডিও দেখা যায়। বইয়ের সাথে টেকনোলজির এই সংযোগ গল্পের বইগুলোকে করে তুলেছে আরও আকর্ষনীয়।

এভাবেই অ থেকে চন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত বাংলা ভাষার ৫০টি অক্ষরকে নিয়ে গল্পের বই তৈরি করার নজির পৃথিবীতে আর কোন ভাষায় নেই। বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকে বাংলা ভাষাভাষী শিশুদের কাছে আকর্ষনীয় করে তোলার এই বিশাল যজ্ঞটি ব্যক্তিগতভাবেই অর্থায়ন করেছেন ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়ার প্রতিষ্ঠান লাইট অফ হোপ। আগামী ২০২৬ সালে শেষ হবে পুরো ৯ খন্ডের কাজ।

বর্ণগল্প সিরিজের বইগুলো ইতিমধ্যে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে শিশু, অভিভাবক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনদের মধ্যে। বইগুলো ইতিমধ্যে অনেক স্কুলের লাইব্রেরিতে স্থান করে নিচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমে পড়া শিশুদের কাছেও একইভাবে জনপ্রিয় এই বইগুলো। ঢাকার বিভিন্ন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো এখন গুফির বইগুলো ব্যবহার করছে তাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাংলা ভাষা ও বাংলা গল্পের বইকে জনপ্রিয় করার কাজে। শুদ্ধ উচ্চারনে গল্পগুলো পড়ে শুনানোর ভিডিওগুলো সাহায্য করছে শিশুদের সঠিক উচ্চারণ শিখতে, এবং নিজেদের বাংলা শব্দ ভান্ডার বাড়াতে।

প্রকাশক হওয়ার পাশাপাশি ওয়ালিউল্লাহ ভূঁইয়া নিজেও বেশ কিছু গল্পের লেখক। কাজ করছেন ‘বুক ডিরেক্টর’ হিসাবে। তাঁর কথা হচ্ছে, সিনেমাতে যদি একজন ডিরেক্টর থাকে, তাহলে গল্পের বইয়ের ক্ষেত্রে কেন নয়? কারণ এই গল্পের বইয়ের পাতাগুলো থেকেই তো তৈরি হবে এনিমেশন। সেই পথেও ইতিমধ্যে তিনি হেঁটে ফেলেছেন। গুফির এই বইগুলোর উপর ভিত্তি করে ইতিমধ্যে জনপ্রিয় টিভি চ্যানেল দুরন্ত তৈরি করেছে ‘রঙ বেরঙের গল্প’ অনুষ্ঠান। সেখানে নতুন করে ডায়ালগ ও এনিমেশন করে ইতিমধ্যে প্রচারিত হচ্ছে চ্যানেলটিতে। সেগুলো দেখছে লক্ষ লক্ষ শিশুরা, সারা বাংলাদেশ থেকে। বইগুলোর অডিও ভার্সন সরাসরি শুনা যাবে জনপ্রিয় অডিও প্লাটফর্ম কাব্যিকে।

ওয়ালিউল্লাহ ভুঁইয়া বলেন, “গল্পের বইগুলো হচ্ছে গল্পের প্রাথমিক মিডিয়াম। কিন্তু এরপর সেই মিডিয়াম থেকেই আমরা ভিডিও, টিভি, অডিও এরকম বিভিন্ন প্লাটফর্মে নিয়ে যাচ্ছি গল্পগুলোকে। এতে করে কেবল বই নয়, বিভিন্ন অন্য মিডিয়ামেও শিশুরা গল্পগুলোর এক্সেস পাচ্ছে। যেই ইউটিউবে শিশুরা এখন সময় কাটায়, সেখানেও এখন গল্পগুলোর এনিমেটেড স্টোরি শিশুরা দেখতে পারবে।”

“আমরা মনে করি শিশুরা বাংলা শেখার প্রতি আগ্রহ নেই। আসলে শিশুদের দোষ দেয়ার কিছু নেই। আমরা তাদের কাছে ভালো মানের কি কনটেন্ট তুলে দিচ্ছি? বাংলায় ভালো বই, ভালো কনটেন্ট না পাওয়ার কারণেই তারা ঝুঁকছে ইংরেজি কন্টেন্টের প্রতি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন যদি আমাদের কাছেও ইন্টারনেট আর স্মার্টফোন থাকতো, তাহলে আমরাও হয়তো একই কাজ করতাম।”

“এখন আমরা এবং আমাদের শিশুরা গ্লোবাল সিটিজেন। তাই আপনাকে গ্লোবাল স্টান্ডার্ডের কনটেন্ট, বই তৈরি করতে হবে যদি আপনি এই যুগের শিশুদের জীবনের অংশ হতে চান।”

২০২০ সালেও যেখানে শিশুতোষ প্রকাশনীতে তেমন উল্লেখযোগ্য কাজ বাংলাদেশে ছিল না, সেখানে মাত্র ৫ বছরের মাথায় গুফি এই পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে নতুন একটা উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এবারের বইমেলাতেও সেটার প্রতিফলন দেখা গেছে। অন্য স্টলগুলোতে যেখানে কোন ভিড় নেই, সেখানে গুফির স্টলে সবসময় শিশু আর অভিভাবকদের ভিড় লেগেই আছে। এটাই প্রমাণ করে, গুফির বইগুলো ইতিমধ্যে কতটা আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।

গুফির ফাউন্ডার ওয়ালিউল্লাহ ভুঁইয়া বলেন, আমার লক্ষ্য ছিল শিশুতোষ প্রকাশনা এবং শিশুদের জন্য ব্র্যান্ড তৈরি করার মাধ্যমে পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে একটা স্বপ্ন দেখানো যে, বাংলাদেশেও কেউ যদি ভালো মানের শিশুতোষ বই করে, সেটার একটা বড় মার্কেট রয়েছে। এই ধরণের বইয়ের চাহিদা রয়েছে এখনকার অভিভাবকদের মধ্যে। গুফির বইগুলো প্রকাশ হওয়ার পর থেকে এবং মার্কেটে সেটা ভালো সাড়া পাওয়ার পর এখন অন্য প্রকাশকরাও সাহস নিয়ে এগিয়ে আসছে। এবং এখন আগের তুলনায় ভালো কোয়ালিটির বই প্রকাশিত হচ্ছে।

যুগের সাথে সাথে ভাষা ও সাহিত্যকেও এগিয়ে যেতে হয়। সেই সুকুমার রায়, কিংবা ঠাকুমার ঝুলির পর বাংলা ভাষায় কালজয়ী কাজ তেমন হয়নি। এমনকি সেই ক্লাসিক লেখাগুলোকেও বর্তমান যুগের শিশুদের উপযোগী করে প্রকাশ করার উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বাংলা শিশুতোষ সাহিত্য, গল্প, কবিতাকে নতুন যুগের শিশুদের উপযোগী করে করতে না পারলে এখনকার শিশুরা ইংরেজি ভাষার রাইম বা ছড়া, কিংবা গল্পের চরিত্রদের প্রতি আকর্ষিত হবে – এতে আর আশ্চর্যের কিছু নেই।

তাই বাংলা ভাষা শিক্ষা ও বাংলা ভাষায় শিশুতোষ সাহিত্যকে এগিয়ে নিতে গুফির মতো অন্যদেরকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

Top 20 Bedtime Story Books
Close My Cart
Close Wishlist
Close Recently Viewed
Close
Close
Categories